কক্সবাজারে পাঁচ দিনে আড়াই কোটি টাকার শামুক-ঝিনুকের পণ্য বিক্রি

আবদুল কুদ্দুস :

কক্সবাজারে সমুদ্রসৈকতে এখন লাখো পর্যটকে ভরপুর। পর্যটকেরা সমুদ্রের লোনাজলে শরীর ভেজানোর পাশাপাশি আশপাশের দোকানপাটে গিয়ে কেনাকাটাও সারছেন। কেনার তালিকার শীর্ষে আছে শুঁটকি মাছ ও শামুক-ঝিনুক দিয়ে তৈরি রকমারি পণ্য। ঈদের ছুটির গত পাঁচ দিনে সৈকত ও আশপাশের পাঁচ শতাধিক দোকানে বেচাবিক্রি হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি টাকার শামুক-ঝিনুকের পণ্য।

১০ মে পর্যন্ত আরও দেড় কোটি টাকার শামুক-ঝিনুকের পণ্য বিক্রির আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর শামুক-ঝিনুকের পণ্য বিক্রির পাঁচ শতাধিক দোকান বন্ধ ছিল। মাঝেমধ্যে সীমিত আকারে দোকানপাট খোলা রাখা হলেও সৈকতে পর্যটকের সমাগম নিষিদ্ধ থাকায় বেচাকেনা তেমন হয়নি। সম্প্রতি করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে দোকানপাট খোলা হয়। ঈদের ছুটিতে সৈকতে লাখো পর্যটকের সমাগম চলছে। পর্যটকেরা বাড়ি ফেরার সময় প্রিয়জনদের উপহার হিসেবে দিতে শামুক-ঝিনুকের রকমারি পণ্য কিনছেন। তাতে ব্যবসায় চাঙাভাব ফিরে এসেছে। শামুক-ঝিনুক সংগ্রহ, বেচাকেনা, প্রক্রিয়াজাতকরণ, উৎপাদন এবং পণ্য বেচাবিক্রি ও সরবরাহে জড়িত অন্তত দুই লাখ মানুষ।

কক্সবাজার বিচ পার্ক ঝিনুক মার্কেট ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি মোশারফ হোসেন বলেন, গত শুক্রবার এক দিনে সৈকতে নেমেছেন দুই লাখের বেশি পর্যটক। গত পাঁচ দিনে অন্তত সাত লাখ পর্যটক সৈকতে নেমেছেন। তাঁদের একটি অংশ বাড়ি ফেরার সময় শামুক-ঝিনুকের পণ্য কিনে নিচ্ছেন। এখন ছোট–বড় প্রতিটি দোকানে ১০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি হচ্ছে। প্রতিটি দোকানে দৈনিক গড়ে ১০ হাজার টাকা করে ধরলে ৫০০ দোকানে বিক্রি হয়েছে ৫০ লাখ টাকার শামুক-ঝিনুকের পণ্য। পাঁচ দিনে বিক্রি হয়েছে আড়াই কোটি টাকার পণ্য।

শহরের সবচেয়ে বড় ঝিনুক মার্কেটটি সৈকতের লাবনী পয়েন্টে। এখানে শামুক-ঝিনুকের পণ্য বিক্রির দোকান আছে ৫৪টি। সকাল ৯টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত সরগরম থাকছে বেচাবিক্রি। এই মার্কেটের উত্তর পাশে মেসার্স আফসার স্টোরে মজুত আছে প্রায় ২০ লাখ টাকার শামুক-ঝিনুকের পণ্য। গতকাল শনিবার সকালে দোকানে গিয়ে দেখা গেছে, দুজন পর্যটক ঝিনুক দিয়ে তৈরি গলার মালা, কানের দুল ও দরজার পর্দা কিনছেন।

দোকানের ব্যবস্থাপক সাফায়েত হোসেন বলেন, সকালে দোকান খোলার পর প্রথম দুই ঘণ্টায় চার হাজার টাকার পণ্য বিক্রি হয়েছে। আগের দিন শুক্রবার বিক্রি করেন ২৬ হাজার টাকার পণ্য।

শহরের কলাতলী সৈকত, সুগন্ধা সড়ক, সুগন্ধা সৈকত, লাবনী পয়েন্ট, জেলে পার্ক, টেকপাড়া বার্মিজ মার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকায় শামুক-ঝিনুকের পণ্য বিক্রির দোকান আছে পাঁচ শতাধিক। গভীর রাত পর্যন্ত দোকানগুলোতে বেচাবিক্রি হচ্ছে।

কলাতলী সৈকতে একটি দোকানে ১৫ টাকা দরে ৩০টি ঝিনুকের মালা কেনেন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার গৃহবধূ সাবিনা ইয়াসমিন। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, সস্তায় কেনা মালাগুলো দেখতে খুবই সুন্দর। মালাগুলো উপহার হিসেবে পেলে প্রিয়জনেরা খুব খুশি হবে।

মাঝারি সাইজের কয়েকটি কড়ইয়ে বিভিন্ন জনের নাম লিখে নিচ্ছেন ঢাকার সূত্রাপুরের ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘কড়ই শামুকে ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজনের নাম লিখে নিচ্ছি। ঢাকায় ফিরে এসব উপহার হিসেবে বিতরণ করা হবে।’

বর্তমানে বিভিন্ন দোকানে শামুক দিয়ে তৈরি রকমারি গয়না (মাথার খোঁপা, কানের দুল, হাতের বালা, গলার সেট) বিক্রি হচ্ছে ৩ টাকা থেকে ৫০০ টাকায়। ঝিনুকের পণ্য দিয়ে তৈরি মালা বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ২০০ টাকায়। মুক্তার মালা (ছোট–বড়) ১০০ থেকে ৮০০ টাকা, কানের দুল, হাতের বালা, আংটি, হাতের চুড়ি ৫০ থেকে ১৫০ টাকা, মেইকা ঝাড়বাতি ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা, ঝিনুকের ল্যাম্প ৩০০ থেকে ৯০০ টাকা, ডুলা ঝাড়বাতি ২০০ থেকে ৮০০ টাকা, ঝরনা বাতি ২০০ থেকে ৭০০ টাকা, শামুক দিয়ে তৈরি রাজমুকুট ৬০০ থেকে ১ হাজার টাকা ও ল্যাম্প সেট ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, জেলার টেকনাফ, শাহপরীর দ্বীপ, সেন্ট মার্টিন, মহেশখালী, উখিয়া, সোনাদিয়া ও কুতুবদিয়া সমুদ্র উপকূলে জোয়ারের পানিতে ভেসে আসে অসংখ্য মরা শামুক ও ঝিনুক। স্থানীয় অনেকে এই শামুক-ঝিনুক সংগ্রহ করে ব্যবসায়ীদের কাছে কেজি দরে বিক্রি করেন। পরে এসব শামুক-ঝিনুক কক্সবাজার শহরে এসে পরিষ্কার ও প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এরপর শহরের বাহারছড়া, কলাতলী, ঘোনাপাড়া, সৈকতপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকার ঘরে ঘরে শামুক-ঝিনুক দিয়ে রকমারি পণ্য তৈরি করা হয়। বিশেষ করে নারীরা ঘরে বসে অবসর সময়ে শামুক-ঝিনুক দিয়ে রকমারি মালা তৈরি করেন।

৩০ বছর ধরে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বলেন, বঙ্গোপসাগরের তলদেশ থেকে জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা শামুক-ঝিনুক রয়েছে ১২০ প্রজাতির বেশি। তবে এখন ৩০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক ভেসে আসছে। সম্ভবত পরিবেশদূষণ ও সাগরের তলদেশে শামুক-ঝিনুকের আবাসস্থল নষ্ট হওয়ার কারণে এমনটি ঘটছে।

বর্তমানে রাজমুকুট, বিচ্ছু, কড়ই, ফুলছিলন, বাঘকড়ি, মালপুরি, তিলককড়ি, দাতাচিলন, করতাল, বড় শঙ্খ, ক্যাঙ্গারো, ভোখা শঙ্খ, কাটা শামুক, শক শঙ্খ, উড়ন্ত বলাকা, আংটি শঙ্খ, ছাদক শঙ্খ, বুকচিরা কড়ই, লাল শামুক ও জিংগর শামুক পাওয়া যাচ্ছে।

একসময় টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়া ও মহেশখালীর সোনাদিয়া উপকূলে করতাল থেকে আহরণ করা হতো বিপুল পরিমাণ মুক্তা। কয়েক যুগ ধরে তার বিলুপ্তি ঘটেছে। এখন ভারত ও চীন থেকে আমদানি করা মুক্তার মালা দিয়ে পর্যটকের চাহিদা মেটানো হচ্ছে।

 

/প্রথম আলো/সিবিজে/আ